কৃষ্ণকুমার দাস:
ঢাকার পুরনো বিমানবন্দর, তেজগাঁও। সেখান থেকে বরিশাল। বরিশাল নামার পর রানওয়ে থেকে বেশ খানিকটা হাঁটতে হলো। সেখানেও সেনাকর্তারা আরেক দফা পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দিলেন। এরপর পাশের মাঠে নিয়ে যাওয়া হল ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে। সৌজন্য হিসেবে ভারতের তরফে ত্রিপল তুলে দেয়া হল দুর্গতদের হাতে।
দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছিলাম। যারা ত্রিপল পেলেন, তাদের নাম লিখে প্রতিক্রিয়া নিচ্ছিলাম। আচমকা একজন সেনা অফিসার ছুটে এলেন। বললেন, স্যার আপনাকে ডাকছেন। ভাবলাম, কোন স্যার ডাকছে? এখানের সেনাকর্তারা ডাকবে কেন? কাছে যেতেই প্রণববাবু বললেন, তুমিও তো ভারত সরকারের প্রতিনিধি। দুটো ত্রিপল ওদের হাতে তুলে দাও। অভিভাবকসুলভ সেই নির্দেশ অমান্য করার সুযোগ ছিল না।
আজ বারবার সেই কথা মনে পড়ছে। বিদেশের মাটিতে গিয়ে আর কখনও বলবেন না, তুমিও তো ভারত সরকারের প্রতিনিধি, এসো ত্রিপল দাও। আর সেদিন বরিশালের মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রণববাবু যে ছোট ভাষণ দিয়েছিলেন, তার কয়েকটা লাইন আজও মনের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। বলেছিলেন, ‘সিডর শুধু বাংলাদেশের নয়, বাঙালির হৃদয় তছনছ করে দিয়েছে। শুধু বরিশাল বা বাগেরহাটের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হননি, আঘাত পেয়েছে বাঙালির সংসার, তাই আমরা ছুটে এসেছি।’
এর আগে সকালে ভারত থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয়। বসিরহাটের ওপর দিয়ে সাতক্ষীরার দিকে তখন উড়ে যাচ্ছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আমরা তিন সাংবাদিক দমদম থেকে উঠেছি। শীতের সকালে বিমানে উঠতেই কফি দিয়েছেন বিমানসেবক। সবে কফিতে চুমুক দিয়েছি, আর তখনই ডাক পড়ল ভেতরের চেম্বারে। কী, কেমন আছো কৃষ্ণ?
পর্দা সরিয়ে ঢুকতেই স্নেহভরা প্রশ্নের আশ্রয়ে উল্টোদিকের সোফায় বসার সুযোগ দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। খবর জানতে চাইলেন পুরনো সহকর্মী, পার্টিনেতা আশুর। মিনিট পাঁচেক সময়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনা থেকে শুরু করে ছাত্ররাজনীতির পুরনোদের খবর নিলেন। গলগল করে বলে গেলেন, গোবিন্দ নস্কর, কুমুদ ভট্টাচার্যের কথা। শুনলেন নিজের শিক্ষকতা করার প্রতিষ্ঠান আমতলার বিদ্যানগর কলেজের কথাও। বলে দিলেন, ঢাকায় যে ‘সিডর’ ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখতে যাচ্ছেন, সেই ভয়ংকর সাইক্লোনের নামটা শ্রীলংকার দেয়া।
এটাই প্রণব মুখার্জি, জন্মেছিলেন শিক্ষক হয়েই। হাওড়ার স্কুল, আমতলার কলেজ থেকে শুরু করে নানা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছেন। কিন্তু তার চেয়ে অনেক বেশি শিখিয়েছেন দেশের রাজনৈতিক নেতাকর্মী থেকে শুরু করে আমলা, অফিসার এবং অবশ্যই সাংবাদিকদের।
একটা ক্লাসের কথা বলি। ১৯৯৫ সালের পুরভোটের আগে বামফ্রন্ট কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মূল ইস্যু করল ডাঙ্কেল চুক্তি। আসল নাম গ্যাট চুক্তি। বামদের প্রচার ছিল, এই চুক্তিতে দেশের নিম, তুলসীগাছ সব বিক্রি করে দিয়েছেন কেন্দ্রের বাণিজ্যমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। ভারত সরকারের হয়ে আগের বছর পহেলা বৈশাখের দিন (১৯৯৪ সালের ১৫ এপ্রিল) ওই চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন তিনি। কিন্তু কীভাবে বামদের অপপ্রচারের মোকাবেলা হবে?
প্রণববাবু বললেন, ২৯৪ বিধানসভা কেন্দ্র থেকে একজন করে বক্তা নিয়ে সারা দিন ক্লাস করাবেন তিনি। তারাই নিজের কেন্দ্রে গিয়ে অন্যদের শেখাবেন, জবাব দেবে অপপ্রচারের। জাদুঘরের পেছনে আশুতোষ জন্মশতবার্ষিকী হলে ছয় ঘণ্টার ক্লাস হল। প্রশ্নোত্তর পর্বও চলল। জনে জনে সবাইকে পড়া ধরার মতো করে সেদিন ক্লাস নিয়েছিলেন। সেই ঘটনার ছবি এখনও চোখে ভাসে।
দিনপনেরো পরে পুরভোটের প্রচারসভায় তিনি নিজে বসে থেকে ওই ক্লাসে শেখানো ছাত্রদের দিয়ে বক্তব্য রাখালেন। পরে প্রণববাবু বলতে উঠে নিজস্ব বাচনশৈলীতে বললেন, ‘আগের বক্তা ছিল বাংলার একজন ছাত্র। দেখলাম সে যেভাবে গ্যাট চুক্তি বুঝেছে, তাতে আমি নিশ্চিত, বামদের ধাপ্পা আর কাজে লাগবে না।
তাই আমি গ্যাট চুক্তি নিয়ে আর একটি কথাও বলব না। আমি বলব, কেন্দ্রের পাঠানো উন্নয়নের টাকা কীভাবে আত্মসাৎ করছে সিপিএম। বাম রাজত্বের দুর্নীতির কথা।’ এটাই ছিলেন প্রণববাবু, ছাত্র কেমন শিখেছে, তা হাতেকলমে পরীক্ষা নিতেন সবাইকে দেখিয়েই।
ছাত্ররাজনীতি করার সুবাদে দীর্ঘদিন ধরে শুধু আমায় নয়, আমার মাকে চিনতেন। সাংবাদিকতা পেশা হিসেবে গ্রহণ করার পর অনেক কর্মসূচিতে দেখা হলেও সেটাই ছিল পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে প্রণববাবুর সঙ্গে আমার প্রথম বিদেশ সফর। দিনটা ছিল ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর, বুধবার। পরে তার সঙ্গে আরও গিয়েছি, কিন্তু ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পাশে অভিভাবক হয়ে তার পাশে দাঁড়ানোর মুহূর্ত ছিল ঐতিহাসিক।
বিমানের দুটো ভাগ। বাইরের অংশে বসে সাংবাদিক ও অফিসাররা। ভেতরে গুরুত্বপূর্ণ ফাইল দেখছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সঙ্গে আপ্তসহায়ক সাবেক যুব কংগ্রেস সভাপতি প্রদ্যুৎ গুহ। সেবার পাঁচ সাংবাদিকের মধ্যে দু’জন ছিলেন পিটিআই ও এএনআই-এর। কলকাতা থেকে দু’জন উঠেছিলেন।
ঢাকা বিমানবন্দরে নামার পর প্রণববাবু সটান গেলেন পদ্মা নামে একটা সরকারি বাড়িতে। অনেকটা আমাদের নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউস বা কলকাতার সৌজন্যের মতো সরকারি বাড়ি। সেখানেই দেশের ক্ষয়ক্ষতির বিস্তারিত তালিকা ও ছবি প্রতিবেশী দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দেখালেন বাংলাদেশ সরকারের অফিসাররা।
বরিশাল, বাগেরহাট, খুলনার ওপর দিয়ে সিডরের কী তাণ্ডব চালিয়েছে, তা দেখানো হল ‘বাংলাদেশ বন্ধু’ প্রণবকে। মিটিং শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদেরও মধ্যাহ্নভোজ হল। এরপরই রওনা হলাম বরিশালের উদ্দেশে।
কৃষ্ণকুমার দাস : কলকাতা প্রতিনিধি
Leave a Reply